মাগুরার একমাত্র বীরপ্রতীক,গোলাম ইয়াকুব মোল্লা: এক বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনগাথা

️ বীর প্রতীক মোঃ গোলাম ইয়াকুব মোল্লা
নহাটার সাহসী সন্তান, স্বাধীনতার অগ্রসেনানী

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মাগুরা জেলার ভূমিকা ইতিহাসের গর্ব।
এই জেলার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের এক মাটির ছেলে,বীর প্রতীক মোঃ গোলাম ইয়াকুব মোল্লা তাঁর অসীম সাহস, ত্যাগ ও নেতৃত্বের জন্য জাতীয়ভাবে স্বীকৃত হয়েছেন।
১৯৭১ সালের ভয়াবহ যুদ্ধের সময় তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে নিজ ভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন শেষ পর্যন্ত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে
সরকার তাঁকে “বীর প্রতীক” খেতাবে ভূষিত করে।

জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়ঃ
নাম: মোঃ গোলাম ইয়াকুব মোল্লা
খেতাব: বীর প্রতীক
গ্রাম: নারানদিয়া
ইউনিয়ন: নহাটা
থানা: মহম্মদপুর
জেলা: মাগুরা
পিতা: জমিরউদ্দীন মোল্লা
মাতা: সাজু বিবি
স্ত্রী: শামছুন্নাহার
সন্তান: পাঁচ পুত্র ও এক কন্যা
খেতাবের সনদ নম্বর: ৩৮২
মৃত্যু: ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ

সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়েও গোলাম ইয়াকুব মোল্লা ছিলেন দূরদৃষ্টি ও দৃঢ়চেতা মানুষ।
তাঁর শৈশব থেকেই ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর মানসিকতা তাঁকে তৈরি করে দিয়েছিল একজন অদম্য মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।

মুক্তিযুদ্ধে যোগদানঃ
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গোলাম ইয়াকুব ছিলেন আনসার বাহিনীর সদস্য। দেশে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। প্রথমে স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন, পরে ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দলের নেতৃত্ব দিয়ে
তাঁকে গেরিলা অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মাগুরা অঞ্চলে।

নবগঙ্গা নদীর পাশে অ্যাম্বুশ অভিযানঃ
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অন্যতম স্মরণীয় যুদ্ধ হলো নহাটার নবগঙ্গা নদীর পাশে অ্যাম্বুশ অভিযান।

তারিখ: ২১ আগস্ট ১৯৭১
অবস্থান: নহাটা বাজারের পাশের নবগঙ্গা নদীর ঘাট

তথ্যানুযায়ী, পাকসেনা ও রাজাকারদের একদল নৌকাযোগে
নবগঙ্গা নদী পেরিয়ে নহাটায় আসবে— এই খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে যায় গুপ্তচরের মাধ্যমে।
গোলাম ইয়াকুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন শত্রুদের অ্যাম্বুশ করার।

তাঁর দলে ছিলেন মাত্র ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য –
ময়মনসিংহের অসীম সাহা,
যশোরের দেলোয়ার ও গরিব হোসেন,
মাগুরার শ্রীপুরের পরিতোষ প্রমুখ।

তাদের হাতে ছিল:
৭টি SLR রাইফেল
১টি SMG
৩টি সাধারণ রাইফেল

অন্যদিকে শত্রুপক্ষের সংখ্যা প্রায় ১০০ জনেরও বেশি। মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন নহাটা বাজারের পাকা স্কুল ভবনের ছাদ ও তহশিল অফিসে। এলাকাটি তখন ফাঁকা—স্থানীয়রা নিরাপদ স্থানে সরে গেছে।

পাকসেনারা ঘাটে নেমেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণে হতচকিত হয়ে পড়ে। গোলাম ইয়াকুবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল আঘাত হানেন। হঠাৎ আক্রমণে পাকসেনাদের প্রায় ৩০–৩৫ জন নিহত হয়, আরো অনেকে আহত হয়ে নদীপারে পিছু হটে যায়। পরদিন ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা আবার আকস্মিক আক্রমণ চালান, এতেও বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়।

এই অভিযানে গোলাম ইয়াকুবের বীরত্ব ও নেতৃত্ব
পুরো অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

জয়রামপুর যুদ্ধঃ
নহাটার অভিযানের কয়েকদিন পর গোলাম ইয়াকুব নেতৃত্ব দেন মহম্মদপুর থানার জয়রামপুরে একটি সম্মুখযুদ্ধে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দখল করতে সক্ষম হন।

খেতাব ও সম্মাননাঃ
মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহস ও নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ গোলাম ইয়াকুবকে দেওয়া হয় বীর প্রতীক খেতাব। এটি বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ gallantry award (যুদ্ধকালীন বীরত্বের সম্মাননা)।
তাঁর খেতাবের সনদ নম্বর: ৩৮২।

পরবর্তী জীবন ও মৃত্যুঃ
স্বাধীনতার পর তিনি সাধারণ জীবনে ফিরে আসেন এবং সমাজ ও তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কাজ চালিয়ে যান। ২০০১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজও নহাটার মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।

শিক্ষা ও অনুপ্রেরণাঃ
বীর প্রতীক মোঃ গোলাম ইয়াকুব মোল্লার জীবনের মূল বার্তা হলো —
“দেশের প্রতি ভালোবাসা ও অটল সাহসই পারে অসম যুদ্ধকে জয়ী করতে।”
ছোট দল, সীমিত অস্ত্র — তবুও তাঁর দৃঢ় মনোবল ও নেতৃত্ব
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে আছে। আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য তিনি এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা, যিনি শিখিয়েছেন— স্বাধীনতা মানে আত্মত্যাগ, আর সেই আত্মত্যাগই প্রকৃত দেশপ্রেম।

সূত্রঃ
একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা,
প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান
সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

▫️লেখক
শিমুল পারভেজ
সম্পাদক,পজিটিভ নহাটা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *