১৯৭১—বাংলার আকাশে যখন স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের জন্য রক্ত ঝরছিল, তখন মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার নহাটা ইউনিয়নের এক নিভৃত গ্রাম জয়রামপুর হয়ে উঠেছিল যুদ্ধক্ষেত্র।
এই জনপদের বীর সন্তানরা, বীর প্রতীক মোঃ গোলাম ইয়াকুব মোল্লা-এর নেতৃত্বে, জীবনের বিনিময়ে শত্রুমুক্ত বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
যুদ্ধের সূচনা ও প্রেক্ষাপট
তারিখ ছিল ১৬ অক্টোবর ১৯৭১। সময় দুপুর ১টা। চারদিক নিস্তব্ধ — কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের ভিতর তখন জ্বলছে প্রতিশোধ ও মুক্তির আগুন। পাক হানাদার বাহিনী জয়রামপুর অঞ্চলে প্রবেশ করলে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগতভাবে অবস্থান নেন এবং মুহূর্তেই শুরু হয় সম্মুখসমর।
যুদ্ধ চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত, টানা পাঁচ ঘণ্টা ধরে। গর্জে ওঠে রাইফেলের শব্দ, কেঁপে ওঠে নয়নাভিরাম গ্রাম জয়রামপুর।
অসীম সাহসের প্রদর্শন
প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নেন। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন সাহস ও প্রজ্ঞার প্রতীক বীর প্রতীক গোলাম ইয়াকুব মোল্লা। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে পাক বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ চালান।
তাদের সাহস, কৌশল ও দেশপ্রেমের কাছে ভারী অস্ত্রসজ্জিত শত্রুরাও টিকতে পারেনি।
এই তুমুল যুদ্ধে প্রায় ১০০ জন পাক সেনা নিহত হয়, বাকিরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। জয়রামপুরের মাটিতে সেদিন রচিত হয় এক অবিস্মরণীয় বিজয়ের ইতিহাস।
শহীদের রক্তে লেখা স্বাধীনতার গান
যুদ্ধ চলাকালীন কৌশল পরিবর্তনের এক সংকটময় মুহূর্তে গুলি এসে লাগে এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার শরীরে। তিনি আর কেউ নন – শহীদ আবীর হোসেন।
গুলিতে তাঁর বাম উরু ও পেট বিদ্ধ হয়, এবং মুহূর্তেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
নাম: শহীদ আবীর হোসেন
পিতা: মনছুর মোল্যা
গ্রাম: কাশিপুর
পাঠাগার ও স্মৃতি সৌধ
বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি স্বরুপ ১৯৮৮ সালে মহম্মদপুর উপজেলা সদরে শহীদ আবীর সাধারণ পাঠাগার নামে একটি পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এবং পরবর্তীতে জয়রামপুরে নির্মান করা হয় মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সৌধ।
নহাটার গর্ব, জাতির প্রেরণা
জয়রামপুর যুদ্ধ কেবল একটি যুদ্ধ নয়—এটি ছিল স্বাধীনতার বিশ্বাসে দীপ্ত মানুষের অটুট প্রতিজ্ঞার প্রতীক।
বীর প্রতীক গোলাম ইয়াকুব মোল্লা ও তাঁর সহযোদ্ধারা প্রমাণ করে গেছেন, দেশপ্রেম ও সাহস থাকলে একটি ছোট্ট গ্রামও ইতিহাসের পাতায় গৌরবের অক্ষরে লেখা যায়।
আজও জয়রামপুরের মাটিতে ভোরের শিশিরে মিশে থাকে তাঁদের রক্তের স্মৃতি, বাতাসে ভেসে আসে সেই গর্জন—
“বাংলা আমার, স্বাধীন আমার—আমার প্রাণের দামেই অর্জিত।”
▫️লেখক
শিমুল পারভেজ
সম্পাদক,পজিটিভ নহাটা
